৩য় পর্ব & শেষ পর্ব
‘ বাহ ! এদিকটার ইতিহাসটা তুমি বেশ জানো দেখছি ‘ – প্রশংসা মিঃ গৌরের মুখে ।
জগজিৎ হাসলেন – ‘ ইতিহাস মানুষের বলুন বা ভূতের দুটোই জানি ! আপনি যেটা শুনতে চান, শোনাতে পারি ।’
মিঃ গৌর হাসলেন – ‘ওই যে দূরে ওই ভাঙা বাড়িটা… ‘
‘… মোড়ো কি হাবেলী ‘- বলল জগজিৎ ।
‘ভেতরে একটু বসা যায়? অসহ্য রোদ ‘।
‘হ্যাঁ, চলুন না ! ‘
‘ মোড়ো – কি-হাবেলী ‘ শহরের মূল ফটকের বাইরে যে একটা ছোট্ট প্রাসাদ জাতীয় কিছু ছিল, তা তার জীর্ণ চেহারায় ধরা পড়ে । এখন অবশ্য রাশি রাশি ইঁটের সারির মাঝে মাঝে বিশাল গবাক্ষগুলো দেখলে মরা খুলির মতো লাগে সেটাকে । তখনকার দিনে রাজ্যগুলি যদি দূর্গ নগরী হতো, তাহলে সেই নগরের একটা বিশেষ প্যাটার্ন থাকতো । মূল নগরের নীচে দিকে অর্থাৎ মূল ফটকের বাইরে থাকতো বাজার ও নিম্নশ্রেনীর গ্রামবাসীর আবাসস্থল । মূল ফটকের ভেতরে একে একে সেনা ছাউনি, মন্ত্রী, সেনাপতিদের আবাসস্থল এবং তারপর নগরের উপকন্ঠে থাকতো মূল রাজপ্রাসাদ । একেই বলা হয় ‘ সিটাডেল এরিয়া ‘ (Citadel Area) । এরূপ নির্মাণের একটা কারণ অবশ্যই বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে মূল রাজপ্রাসাদ বা রাজত্বকে যাতে প্রতিহত করা যায় । ধূসর পাহাড় ঘেরা এই পরিত্যক্ত প্রেতপুরীও ঠিক একইরকমের, চোখ বুঝলেই যেন অতীতটা দেখা যায় । পরিত্যক্ত হাবেলির ভেতরটা অসম্ভব থমথমে । কথা বলে তা যেন দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে শূন্যতার বুকে আছড়ে পড়ে গুরুগম্ভীর দামামা ধ্বনির মতো শোনায় । পায়ের বুটের খটখট শব্দ কানে এসে লাগে । সামনের একটা ভাঙা স্ল্যাপের দিকে আঙুল দেখিয়ে জগজিৎ বলে – ‘ ওইখানটায় বসি চলুন ‘ ।
হাত দিয়ে ধূলোর পারদ সরিয়ে বসার যোগ্য করে দিল জগজিৎ । ছেলেটা বেশ চটপটে । সঙ্গে বিস্কুট ছিল, প্যাকেট কেটে জগজিতের দিকে এগিয়ে দিলেন মিঃ গৌর । তারপর নিজেও একটা কামড় বসিয়ে জল দিয়ে চিবতে চিবতে বললেন – ‘ মান সিং- র ভাই মাধো সিং-এর সম্পত্তির অংশ এই প্রাসাদ, অন্তত ইতিহাস তো তাই বলছে । অার সময়কালটা ১৫৭৩ থেকে ১৬৩১ এর মাঝামাঝি । অর্থাৎ রাজপুত সাম্রাজ্যের দীর্ঘ ইতিহাসের পাতায় এই নগরের স্থায়িত্বকাল মাত্র ৬০ বছর । খুব অবাক লাগছে এ নগর কি গড়ে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংসের পথে পতিত হয়?
জগজিৎ হাতের বিস্কুট দুটো শেষ করে, এক নিঃশ্বাসে বোতলের অনেকটা জল নিঃশেষ করে তারপর উত্তরটা দিল- ‘ এটাই তো মিস্ট্রি স্যার । অবশ্য মতবাদ অনেক অাছে । কিছু ইতিহাসের, আবার কিছুটা মানুষের মন গড়া, এসব একসাথে মিলে জায়গাটা এখন টুরিস্টদের কাছে বেশ দেখবার মতো জিনিস হয়ে উঠেছে ।
প্রতিবছর এখানে লোকের ভীড় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং কি জানেন, যত টুরিস্ট এখানে আসে, তার অধিকাংশই অাসে এই জায়গাটির ভুতুড়ে ইতিহাস আর এই ফাঁকা ধু ধু গা ছমছমে পরিবেশটা অনুভব করতে । কাজেই এই জায়গার গুরুত্ব যে ইতিহাসের পাতায় নয় বরং উর্বর মস্তিষ্কের কোন লেখকের ভুতুড়ে গল্পের প্লটে মানায় – তা বোধহয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন । তবে কি জানেন কয়েকটা ব্যাপার আছে বলি আপনাকে .. যেগুলো ইন্টারনেট কিংবা বইয়ের পাতায় পাবেন না ।
মিঃ গৌর এতক্ষণ বেশ টানটান হয়ে বসেছেন, তিনি যেন এবার একটা দূর্দান্ত ভুতুড়ে গল্পের একদম কার্টেন রাইজারে এসে পড়েছেন, তা উপলব্ধি করেই বোধহয় এরকম আচরণ । জগজিৎ একটানা কথা বলে এবার একটু থেমেছে । আবার অসম্ভব শান্ত চারপাশটা । দূরে কোথাও একটা কাক বিশ্রী সুরে ডেকে উঠলো । তারপর আবার সব চুপচাপ । এবার মিঃ গৌরের মনে হল জগজিৎ বোধহয় ভাবনার মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেছে, তার চোখ দুটো বোজা, ঠোঁট নড়ছে না, সে স্থির । মিঃ গৌর এবার তাকে ডাকতে যাবেন ঠিক তখনই জগজিতের মুখে কথা শোনা গেল । হ্যাঁ জগজিৎ- ই বলল বটে, তবে প্রথমটাই শুনলে মনে হয় কথাটা হাবেলীর ভেতরের কোন ঘর থেকে আসছে । তার গলার স্বর আগের চেয়ে এখন বেশ গম্ভীর , থমথমে ।
‘ মিঃ গৌর আপনি আর্শীবাদ-অভিশাপ -এসবে বিশ্বাস করেন? ‘
মিঃ গৌর ঘাড় নাড়লেন । উপর নীচে নয় পাশাপাশি অর্থাৎ , না । জগজিৎ এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- ‘ জানি, মিঃ গৌর, আমিও এসবে খুব একটা … , বুঝতেই পারছেন পড়াশোনা করেছি, শিক্ষিত মানুষ । চাকরি করি, এসব কি মানা চলে? তবে কি জানেন তো মাঝেমধ্যে এমন অনেক কিছু ঘটে, যার ব্যখ্যা দিতে শিক্ষিত মানুষও বোকা বনে যায় । এ শহরের ইতিহাস আপনি পড়ে এসেছেন । যারা পড়ে সবাই জানে । ১৫৭৩ -এ কচ্ছ রাজপু্ত শাসক জয়পুরের ভগবন্ত দাস তার সৎ ছেলে মাধো সিং কে এ শহর উপহার দেন । তার বড় ছেলে মান সিং -এর তখন বিশাল নামডাক । সে তখন মোগল দরবারে আকবরের চিফ কমান্ডার । তবে প্রচুর প্রতিপত্তি । তাই দাদার প্রতি একপ্রকার ঈর্ষা এড়াতেই ভগবন্ত তাকে এ নগর ভেট দেন । ছবির মতো সাজানো এ নগর । মাত্র ৬০ বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ল । তার কারণ কোন বহিঃশত্রুর আক্রমণ নয় । বরং… এক অভিশাপ ‘
‘ অভিশাপ ?… কিসের অভিশাপ? এটা কি ইতিহাস বলছে? মনে ইতিহাস এর কোন উল্লেখ… ‘ -উত্তেজিত মিঃ গৌর । তিনি শরীরটাকে আগের চেয়ে আরো টানটান করে বসেছেন । স্বভাবতই বোঝা যায় তিনি একই সাথে রোমাঞ্চিত ও উত্তেজিত ।
‘ অবশ্য অভিশাপ একটা না দুটো, তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে । ভনিতা না করে বরং আপনাকে গল্পটা শোনাই … ৫০০ বছরের এক অভিশাপ, আজও বয়ে চলেছে এই ধূ ধূ মৃত শহরটি । ‘
এরপর জগজিৎ বলে চললো – ‘ প্রথমেই বলেছিলাম অভিশাপ একটা নয় বরং অনেকে বলে দুটো । তাই দুটোই শোনাব আপনাকে । তবে প্রথমটির থেকে দ্বিতীয়টি বেশ ইন্টারেস্টিং । প্রথম কাহিনীটি এই বিশাল নগরীর প্রতিষ্ঠা নিয়ে । রাজা ভগবন্ত সিং যখন প্রথম দূর্গ নির্মাণের জন্য ফাঁকা জমির সন্ধান করছিলেন, তখন এই বিশাল জায়গাটি তার চোখে পড়ে । এমন জায়গা যেকোন শাসকেরই দূর্গ নির্মাণের জন্য প্রথম পছন্দ হবে সেটাই স্বাভাবিক এবং তার একটি বিশেষ কারণ চারপাশের এই বিশাল পর্বত বেষ্টনী । বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে খুব সহজেই রক্ষা পাওয়া যায় তাতে । ভগবন্ত সিং-ও তাই এখানেই দূর্গ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন । কিন্তু সে কাজে বাধা সাধলেন এক সাধু । বিস্তৃত জমির এক প্রান্তে তার পত্রকুঠির ।
রাজা তার সাথে সাক্ষাত করে তাকে সমস্ত বিষয়টি জানাতেই তিনি বললেন -‘ দূর্গ নির্মাণে তার আপত্তি নেই কিন্তু সে দূর্গের ছায়া যেন তার কুটিরে এসে না পড়ে । অর্থাৎ দূর্গ বানাও, তার উচ্চতা যেন না বাড়ে । কিন্তু রাজ-রাজাদের মর্জি । তিনি থরি পাত্তা দেবেন এক ভষ্মে মাখা সাধুর কথায় । অতএব সে আর্জি রাখা হলো না । রাজার দূর্গ আকাশ ছুঁলো । আর ঠিক তখনই ক্রুদ্ধ সাধু রাজাকে অভিশাপ দিলেন বছর ঘুরতেই সব শেষ হয়ে যাবে, ধুলোয় মিশে যাবে তার ঔদ্ধত্যের দূর্গের চূড়া । শেষটায় নাকি তাই হয়েছিল । অনেক মনে করেন সাধুর নিষেধাজ্ঞা বোধহয় শুনলেই ভালো করতেন রাজা ভগবন্ত সিং ।’
‘ আর দ্বিতীয়টা? ‘ – প্রশ্নটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে করেছেন মিঃ গৌর, তাকে যে গল্পে পেয়েছে তা বুঝেই বোধহয় মৃদু হাসলেন জগজিৎ ।
‘ ঘড়িতে আড়াইটে বাজে সেটা দেখেছেন? এ বেলায় লাঞ্চটা সেরে নিন, এখনও অনেক কিছু দেখার বাকি ।’
দুটো টিফিন কৌটায় শুকনো রুটি, আলুর তরকারি আর সন্দেশ । খাওয়াটা জমিয়ে না হলেও বেশ কিছুক্ষণ পেট ভর্তি রাখাতে যথেষ্ট। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লেন দুজনে । বাইরে বেরোতেই দেখলেন মাথায় উপর একটা মেঘ এসে পড়াতে রোদের তেজ বেশ খানিকটা কমেছে । কিছুটা এগিয়ে যেতেই পাশাপাশি ছোট ছোট এক কামরার বাড়ির ভগ্নস্তূপ । প্রশ্ন করায় জগজিৎ বলল- এ হচ্ছে জহুরি বাজার । সে সময় নাকি বিশাল হাট বসতো এখানে । দামী গয়না-পাথর বিক্রি হতো এখনে । আজ অবশ্য সেটা যেন ফোকলা দাঁতের সারি, তাদের দেখে হাসছে ।
‘ লোকে বলে রাত বাড়লে এখানে নানা অদ্ভুত সব কান্ড ঘটে ।একবার দুটো ছেলে ওস্তাদি করে ভাঙা পাঁচিল টপকে রাতের আঁধারে ঢুকে ছিল । পরদিন সকালে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় একজনের দেখা মেলে । অন্যজনের সন্ধান মেলেনি । সে ছেলে নাকি বলেছিল এ বাজার নাকি রাতের বেলা এক থাকেনা । কারা যেন এ বাজারে আজও কেনাকাটি করতে আসে । প্রতি জ্যোৎস্না রাতে আজও নাকি সেখানে বাজার বসে । কেনাকাটি হয়, লোকজন আসে… ‘
মিঃ গৌর পাশের ভাঙা ইটগুলো দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললেন – ‘ সে লোকজন যে আদৌ বিংশ শতাব্দীর মানুষ নয়, তা বলাই বাহুল্য ‘ ।
তারপর আরো দুটো মন্দির পেরিয়ে যখন তারা মূল্ ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালেন তখন ঘড়িতে সময় চারটে। জগজিৎ বলল- ‘ স্যার একটু দাঁড়ান । রাতের খাবার অার চায়ের ফ্ল্যাক্সটা নিয়ে নিই । ‘
মিঃ গৌর প্রশ্ন করার জগজিৎ বলল – ‘ তার এক দূরসম্পর্কের ভাই এখানে গেট কিপারের কাজ করে, তাকেই বলা হয়েছে রাতের খাবারের কথা । এখনই এসে পড়বে সে । ‘
বেঁটে খাটো ছোট্টূ খাবার নিয়ে যখন ফটকের কাছে পৌঁছালো তখন ঘড়িতে পৌনে পাঁচটা ।সূর্য পাহাড়ের আড়ালে মুখ লুকোবার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে । ছটার মধ্যে সন্ধ্যে নেমে যাবে । তার অাগে পুরোটা আগে দেখে নেওয়া দরকার । আর সেটা আলো থাকতে থাকতেই ।
জগজিৎ আশপাশের জায়গাগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত টিপ্পন্নী দিয়ে শেষমেশ মিঃ গৌর কে নিয়ে হাজির হল তার আল্টিমেট ডেসটিনেশনে, অর্থাৎ তাদের সামনে এখন সেই আকাশচুম্বী ভানগড় দূর্গ , যার ছায়া সাধুর কুটিরে পড়ায়, সব শেষ হয়ে গেছিল ।
শতাব্দীর পাথুরে পথ,মাঝে মাঝে সুদূর্গ প্রাচীর চূড়া, তা যেন দুহাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছে সেই বিশাল দূর্গটিকে । আজও সেদিকে তাকালে তার অতীতের জৌলুস চোখে পড়ে । চোখ বুঝলেই ধরা পড়ে ৫০০ বছর আগের তার প্রকৃতস্বরুপটা।
খানিকটা এগিয়ে যেতেই প্রাচীরের গায়ে একটা বিশাল গর্ত দেখিয়ে জগজিৎ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘এটা কি বুঝতে পারছেন? ‘
‘ সুরঙ্গ বলে মনে হচ্ছে… ‘
‘ হ্যাঁ ঠিকই সুরঙ্গই বটে, তবে এখন যদি এর ভেতরে ঢোকেন, বাদুড় আর চামচিকি ছাড়া কিছুই পাবেন না ‘
‘আগেকার দিনে রাজ-রাজা এইসব গুপ্ত সুরঙ্গের প্রকোষ্ঠেই ধনরাশি লুকিয়ে রাখতেন বলে শুনেছি ।’ – প্রশ্ন মিঃ গৌরের মুখে ।
‘ সে সব থাকলেও আর পাবার আসা নেই । একসময় বহুমূল্য পাথর ছিল এখানকার মন্দিরের গায়ে । সব গেছে ।’
‘ কি চুরি? ‘
‘ তা ছাড়া ! ভ্যান্ডালিজম বোঝেন তো? ‘
তারা এগিয়ে গেলেন কেল্লার মূল ফটকের দিকে ।সেখানে একটি বিশাল গেট দেখে প্রশ্নটা করলেন মিঃ গৌর- ‘ এটাতো পরে লাগানো তাই না? এ structure তো… ‘
‘ হ্যাঁ, এটা রাতে কেল্লায় অযাচিত প্রবেশ আটকাতে । এসব পরিত্যক্ত কেল্লা দুষ্কৃতীর আখড়া, জানেন তো? ‘
কেল্লার ফটক পেরোতেই অনেকগুলো সিড়ি নানা দিকে সোজা উপরে উঠে গেছে । উপরের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায় । এই বিশাল দূর্গের পেটের মধ্যে নিজেকে নিরীহ একটা পিঁপড়ে বলেই মনে হচ্ছে । মিঃ গৌর মাথা উঁচিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন । তার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে ‘বা-ব্বা! ‘ কথাটা বেড়িয়ে এল । জগজিৎ ততক্ষণ বেশ কয়েকটা ধাপ এগিয়ে গেছে । পিছু ঘুরে ডাক দিলেন – ‘আইয়ে, গৌর -সাব! ‘
দুটো ঘর পেরিয়ে একটা ছাদের অংশ । অবশ্য একে আধুনিক যুগের ব্যালকনির সাথে তুলনা করলেও বিশেষ ভুল হয়না । ছাদের ডান দিকে একটা ছোট্ট মন্দির । জগজিৎ কে জিঞ্জাসা করায় সে বলল –
‘ এটা রানী রত্নাবতীর মন্দির । এই কেল্লার দ্বিতীয় গল্প এই রানী রত্নাবতীকে নিয়েই । রানী রত্নাবতী ছিলেন রাজা মাধো সিং এর স্ত্রী । এই রূপবতী রানীর নাম তখন তামাম রাজপুতানায় । তিনি একাধারে রূপবতী এবং বুদ্ধিমতী । বহু রাজ্যের রাজার মাধো সিং এর প্রতি ঈর্ষার এক অন্যতম কারণ তিনি । আর এই রূপের ঈর্ষাই এক অভিশপ্ত ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল । রানীর রূপের কথা যখন সমগ্র রাজপুতানায় ছড়িয়ে পড়েছে তখন তার রূপে আকৃষ্ট হন এক তান্ত্রিক , নাম সিন্দিয়া । সে রানীকে বশ করবার জন্য বহু প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় । শেষটায় তিনি চাললেন তার মক্ষম অস্ত্র । একটি মন্ত্রপুত শিশিতে তেল ভরে তিনি ছলেবলে তা রানীর কাছে পাঠান । সেই তেল ব্যবহার করলে রানী তার প্রতি আকৃষ্ট হবেন । কিন্তু রানী রত্নাবতী ছিলেন বিচক্ষন । আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে উল্টো মন্ত্র উচ্চারন করে সেই শিশিকে একটা শিলাখন্ডে রূপান্তরিত করে ছুঁড়ে দেন সেই তান্ত্রিকের দিকে । শোনা যায় , রানী রত্নাবতীও তন্ত্রবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন । চাল ঘুরলো , মারা গেলেন তান্ত্রিক । কিন্তু মারা যাবার আগে রানীকে অভিশাপ দিয়ে গেলেন , তার এই বিশাল রাজবংশ চোখের নিমেষে মিশে যাবে মাটিতে … ছাড়খার হয়ে যাবে সব সৌন্দর্য , তার রূপ । আর তারপর … বাকিটা ইতিহাস ।
গল্পটা এক নিঃশ্বাসে বলে গেল জগজিৎ । দূর্গের ছাদ পেরিয়ে সূর্য এখন বিদায় নিয়েছে দূরের পাহাড়ের কোন গোপন আস্তানায় । সন্ধ্যা নামছে । দূর্গের ছাদ থেকে দূরের আকাশে মিলিয়ে আসা সূর্যের শেষ রক্তাভ রেখাটা যেন একটা লাল নিশান হয়ে আকাশে উড়ছে । রাজপুত ইতিহাসে সেটা জয়ের নিশান হলেও এই নির্জন দূর্গের ছাদে সেটা যেন মিঃ গৌর এর মনে অন্য কথা বলছে – এ লাল নিশান যেন কোন আসন্ন বিপদের , সেটা পুব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে বার বার যেন কেউ তাদের নিষেধ করছে – ফিরে যাও ! ফিরে যাও !
অন্তিম পর্ব
‘ রোদটা পড়তেই জায়গাটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল দেখেছেন? আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে নড়তে ইচ্ছা করবেনা । ‘
মিঃ গৌর দূরের পাহাড়ের পিছনে সূর্য অস্ত যাওয়া দেখছিলেন জগজিৎ -এর কথায় পিছন ঘুরে দেখতেই দেখেন সেও সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে ।
‘ সত্যিই এ দৃশ্য চট করে দেখা যায় না । সূর্যের রঙটা.. ‘ এখানেই থামাতে হল মিঃ গৌরকে । একটা কোন পাখি বিশ্রী ভুতুড়ে হাসি হেসে এইমাত্র অদৃশ্য হয়েছে কেল্লার পিছনে একটা ন্যাড়া গাছের মাথায় ।দুজনেই সেইদিকে তাকিয়েছে ।
‘ ইন্ডিয়ান রোলার ‘ বলল জগজিৎ ।
সন্ধ্যা পড়ে গেছে । সূর্যটাও পাহাড়ের পিছনে হারিয়ে গিয়ে পশ্চিমের আকাশে চাঁদমামাকে নাইট ডিউটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে । আজ পূর্ণিমা । চাঁদের গোল থালার মতো নিটোল রূপ মনের কোনে ভয় নয় বরং এ ভগ্নস্তূপের শূন্যতায় এক মায়াবী জগৎ গড়ে তোলে । তাই বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে যে সত্যিই তারা আর সেখান থেকে নড়তে পারবেন না তা বলাই বাহুল্য । তা ভেবেই বোধহয় মিঃ গৌর কথাটা বললেন -‘ ভেতরে চলো, চা খাবো ! ‘
খাঁটি উটের দুধের চা । ঠোঁট ছোঁয়াতেই ‘আহা -বাহা! ‘ প্রশংসা মিঃ গৌরের মুখে । এ জিনিস তিনি আগেও খেয়েছেন । তবে এর স্বাদ একেবারে আলাদা । তারা এখন এসে বসেছেন একটা বড়ো ঘরে । বসা বলতে পাথুরে মেঝেতে চাটাই পেতে বসা । এ জিনিস জগজিৎ-ই এনেছে । চায়ের ফ্ল্যাক্স আর রাতের খাবারের সাথে আর একটা ব্যাগ । তা থেকেই বেরোল এই চাটাই । তাতে আরো কিছু থাকতে পারে এই অনুমান করেই মিঃ গৌর রাতে কি কি লাগতে পারে তার একটা লিস্ট মনে মনে আওড়াছিলেন , হঠাৎ কি মনে হতে প্রশ্নটা করে বসলেন – ‘সাপের ভয় নেই তো রাত-দুপুরে? ‘
জগজিৎ হাসল । তারপর ব্যাগ থেকে একটা শিশি বের করে তাকে দেখালেন । ‘ কার্বোলিক অ্যাসিড ‘ । মিঃ গৌরেরও ছিল , তবে সেটা এখন তার বাড়ির কুলঙ্গিতে ।
জগজিৎ তার ব্যাগ থেকে একটা মোমবাতি বের করে সেটা জ্বালিয়ে রাখল ঘরের কোনায় । সেটা যেন ঘরের অন্ধকার দূর করার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে নিজের চারপাশে একটা আলোকবৃত্ত তৈরী করে পুড়তে থাকলো । ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা থমথমে নিরবতা নেমে এসেছে । সেটা দূর করতেই মিঃ গৌর একটা ছোট্ট গলা খাঁকারানি দিলেন । আর সাথে সাথেই একটা প্রশ্ন জুড়ে দিলেন –
‘আচ্ছা এই যে সবাই বলে ভূত -টুত , আপনি কখনও কিছু দেখেছেন?’
একেই বোধহয় বলে যথা সময়ে যথা প্রশ্ন । অন্ধকার ঘরে মোমবাতির আলোয় এ প্রশ্নই মানায় ।
জগজিৎ বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিল । তাই প্রশ্নটা প্রথমটায় ঠিক শুনতে পায়নি সে । আবার ‘ কি ? ‘ বলে জিজ্ঞেস করায় পুনরায় প্রশ্নটি করলেন মিঃ গৌর । প্রশ্নটা শুনে স্মিত হাসল সে । মোমবাতির আলোটা তার মুখে এসে পড়ায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার মুখটা থমথমে , যেন সে গভীরভাবে কিছু ভাবছে । কি ভাবছে তার নাগাল পাওয়া মিঃ গৌরের সাধ্যের বাইরে। মাইন্ড রিডিং জানলে তো সম্ভব হতো ।
‘ আপনি ভোরের আলো ফোটা অবধি থাকবেন তো? ‘ নীরবতা ভেঙে এরকম একটা প্রশ্ন করবে জগজিৎ সেটা একদমই অপ্রত্যাশিত মিঃ গৌরের কাছে ।
‘ সেকি হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করছেন? ‘ আমি এখানে কি করছি তাহলে ? ‘-শেষের কথাটি একটু রেগেই বললেন মিঃ গৌর । এরকম একটা সিরিয়াস এক্সপিডিশন নিয়ে এধরনের ঠাট্টা তিনি একদম বরদাস্ত করবেন না । কিন্তু জগজিৎ যেন আগের মতোই হাল্কা মেজাজে পরের কথাটা বলল- ” ঠাট্টা কেন? সিরিয়াসলি বললাম । আসলে আগের যতজনকে অ্যাসিস্ট করেছিলাম তারা ভোর হবার আগেই ভেগেছিল কিনা । তাই আপনাকেও একই জিনিস জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি ।’
কথাটা শুনে বিষ্ময়ে মিঃ গৌর ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল, প্রশ্নটা আপনা হতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল- ‘ তার মানে আগেও তুমি… ‘
‘… হ্যাঁ, এই নিয়ে ফোরথ টাইম । ASI থেকে যারাই পারমিশন পায় রাত কাটানোর, তাদের প্রত্যেকেকে আমিই অ্যাসিস্ট করি । কি জানেন, আমরা রাজপুত, ক্ষত্রিয় । আমর ঠাকুরদার বাবা বাঘ মেরেছিলেন বলেও শুনেছি । আমাদের ভয় নেই । কিন্তু কি জানেন মিঃ গৌর আপনি আপনার ভয়ের কারণকে সামনাসামনি দেখলে তাকে তারাতে পারবেন । কিন্তু সে ভয় যদি এমন কিছুর হয় যাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, অথচ স্পষ্ট বুঝছেন আপনার ঠিক পাশেই কেউ… ‘
কথা আর এগোল না। মিঃ গৌর এক ঝটকায় পিছনে চাইলেন । জগজিৎ আগের মতোই স্থির । কতক্ষণ এভাবে নির্বাক স্থির অবস্থায় কাটানো বোঝা গেল না । মিঃ গৌরের কাঁপা হাতে কিছু একটা হাতড়ে চলেছেন । তার টর্চটা । পাঁচ সেলের টর্চটা । কিন্তু সেটা এই অন্ধকারে আর উদ্ধার করা সম্ভব হলনা । এর মধ্যেই জিনিসটা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে দরজা থেকে কিছুটা ভেতরে ঢুকে এসে আবার থমকে দাঁড়িয়েছে । হঠাৎ মিঃ গৌর হো হো করে হেসে উঠলেন – ‘ Stupid ! লোকে কেন ভয় পাবেনা এ সব জায়গায় ! সারাক্ষণ মাথায় ভুত-ভুত ঘুরলে বেড়াল দেখেও মানুষ ভয় পাবে । ‘
হ্যাঁ, বেড়ালই বটে । একটা কালো ধুমসো বেড়াল । জগজিৎ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো । জলের বোতল টা টেনে নিয়ে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে বলল – ‘ Sorry ! আসলে একটা sensation create হয়ে গেছিল । আপনার টর্চটা… ‘
ইতিমধ্যে টর্চটা অন্ধকারেই হাতড়ে উদ্ধার করে ফেলেছেন মিঃ গৌর । সেটা জ্বালিয়ে বেড়ালটার দিকে ফেলতেই সেটা এক লাফে দরজার বাইরে পালালো । আর ঠিক তখনই ঘটলো ব্যাপারটা । দরজার বাইরে বাঁ পাশে সিড়ি নেমে গেছে নীচে । বেড়ালটা লাফিয়ে সরে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা হাল্কা নূপুরের শব্দ যেন সিড়ি থেকে নীচে মিলিয়ে গেল । জগজিৎ আরেকটু হলেই চিৎকার করে ফেলছিল। নিজেকে সামলে নিয়েই চাপা গলায় বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন – ‘শুনলেন? ‘
মিঃ গৌরের টর্চটা তখনও নেভেনি । একইভাবে জ্বেলে রেখেছেন দরজার দিকে তাক করে । তিনি মাথা নাড়লেন । পাশাপাশি নয় , উপর -নীচ । অর্থাৎ ‘হ্যাঁ ‘ । চারপাশ আবার আগের মতোই শান্ত , আর কোন শব্দ নেই । মিনিট পাঁচেক পর মিঃ গৌর চাটাই ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । দরজার কাছ অব্দি এগিয়ে গিয়ে হাতের ইশারায় জগজিৎ -কে ডাকলেন । এবার তিনি দরজা পেরিয়ে সিড়ির দিকে এগোলেন । সেদিকে জোড়ালো টর্চের আলো ফেলে নামতে শুরু করলেন সিড়ি দিয়ে । বেশ কয়েক পা সিড়ি দিয়ে নামতেই যেখানে সোজা সিড়ি শেষ হয়েছে, সেখানে মিঃ গৌরের বুটে কিছু একটা ঠেকলো । টর্চের আলো ফেলে তিনি দেখলেন সেটা একটা ছোট্ট টিনের কৌটো । সেটা ্বেযে শ পুরনো সেটা গায়ের মরচে দেখেই অনুমান করা যায় । মিঃ গৌর সেটা হাতে তুলে নিয়ে টর্চের আলোয় সেটা ভালো করে দেখে জগজিৎ -এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন – ‘ভূতের দেখা বোধহয় আমাদের কপালে নেই । ‘
মিঃ গৌর অন্যমনস্কভাবে একটা গানের সুর গুন গুন করতে করতে হাঁটতে থাকলেন । এটা একতলা । এখানে দুটো বড় কক্ষ আর সামনে একটা খুপরি । নিঃসন্দেহে বলা যায় এটা আরেকটা সুরঙ্গপথ ।হয়তো কেল্লারই কোন প্রান্তে পৌঁছাবার । এখন অবশ্য সে পথে যাবার কোন উপায় নেই । এই অঞ্চল বর্তমানে চামচিকিদের অধিকৃত সাম্রাজ্য । রাজপুতদের পর তারাই যেন গত ৫০০ বছর ধরে মালিকানা ভোগ করে আসছে । খুপরির সামনে দাঁড়িয়ে মিঃ গৌর টর্চের আলো ফেলে দেখলেন সেটা । এর মধ্যেই একটা চামচিকি বোধহয় উড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে গিয়ে তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে আবার সুরঙ্গপথে হারিয়ে গেল । মিঃ গৌর সরে এলেন ।
‘ আচ্ছা, তুমি যে বলেছিলে তুমি আগেও এখানে রাত কাটিয়েছো । কখনও কিছু ঘটতে দেখনি? ‘ এর মধ্যেই জগজিৎ একটা সিগারেট ধরিয়েছে । মিঃ গৌরকে অফার করায় তিনি ‘ no thanks ‘ বলে এড়িয়ে গেলেন । তিনি টর্চটা নিভেয়েছেন । অন্ধকারে এখন জগজিতের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না । কেবল সিগারেটের জ্বলন্ত ফুলকিটা মাঝে মাঝে উজ্জ্বলভাবে জ্বলে উঠলে তার মুখের নীচের অংশটা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে । অন্ধকারেই জগজিতের গলা শোনা গেল – ‘ দু’বছর আগের একটা ঘটনা বলি আপনাকে । সেবার আমি এক উড়ে ছোকরার সঙ্গে রাত কাটিয়ে ছিলাম । তার বাড়ি সে বলেছিল ভুবনেশ্বর । নামটা ঠিক মনে নেই । ASI -এর সহায়ককে বলে রাতে থাকার পারমিশন যোগার করেছিল । সহায় আমার বলল, আমি রাজি হয়ে গেলাম । ছেলেটা প্যারানরম্যাল এক্সপার্ট । সে হাতে একটা স্ফটিক বল নিয়ে খুঁজবে এখানে কোন নেগেটিভ এনার্জি আছে কিনা । আর সে খোঁজাখুঁজি হবে রাতে, অন্ধকারে । সে এও বলেছিল সে নাকি অশরীরী উপস্থিতি অনুৃভব করতে পারে । যাকে বলে clairsentient । তাই রাত হতেই আমায় নিয়ে সে ঘুরে বেড়াতে লাগালো সারা কেল্লায় , সেই সাদা বল নিয়ে । আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম – ‘আচ্ছা , তুমি বুঝবে কি করে যে এখানে কি আছে? তখন সে সেই বলের মধ্যে আঙুল দেখিয়ে বলল -‘ এই বলের মধ্যে যখন নীল ছোপ ধরতে শুরু করবে তখন বুঝবে কোন নেগেটিভ এনার্জি ঘুরে বেড়াচ্ছে, ব্যাপারটা শুনেই মনে মনে একটা রোমাঞ্চ বোধ অনুৃভব করলাম । এক দৃষ্টে বলের দিকে তাকিয়ে চললাম তার সঙ্গে, তারপর এক অদ্ভুত কান্ড… ‘
জগজিৎ চুপ । মিঃ গৌর এবার বেশ বিরক্তি ও উত্তেজিত হয়েই বললেন -” কি দেখলে বলো ! ‘
‘ দু’ বছর আগের কথা । এখনও স্পষ্ট মনে আছে স্যার ।… ঠিক এই জায়গায়, ওই খুপরির সামনে… ‘ জগজিৎ অন্ধকারেই আঙুল নির্দেশ করছে সেই পরিত্যক্ত খুপরির দিকে । সে বলে চলল -‘ স্ফটিকের বলে তখন সত্যিই নীল ছাপ পড়তে শুরু করেছে । বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি স্পষ্ট দেখছি দাঁড়িয়ে আর ঠীক তখনই এক ভয়ঙ্কর কান্ড । ছেলেটা ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল । সাদা স্ফটিকের বল তখন ভেঙে গড়িয়ে গেছে সিড়ির দিকে । আমার সঙ্গে জলের বোতল ছিল । মুখ চোখে জল দিতে ই তার জ্ঞান ফিরে এল । ব্যাস তারপর ততক্ষণাত তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । পুরোপুরি ধাতস্থ হতে তার বেশ সময় লেগেছিল । ‘
এতক্ষণ গল্প বলার মতো কথাগুলো বলে গেল জগজিৎ । মিঃ গৌর চুপ করে শুনলেন । কতকটা এই অন্ধকার নিঃশ্চুপ পরিবেশের জন্যই হোক কিংবা জগজিৎ-এর গম্ভীর গলায় তার ভাষাশৈলীর গুনেই হোক তার চোখ আপনা থেকেই অন্ধকার খুপরির দিকে চলে গেল। সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সেই অন্ধকার হাঁ মুখ থেকে অজস্র চামচিকি চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে আসবে এক্ষুনি । তাদের জ্বলন্ত চোখ, মোটেই ভয় পাবেনা তার হাতের পাঁচ সেলের টর্চের তীব্র আলোয়.. ।
ঘড়িতে ৮: ১০ । বাড়িতে থাকলে এত আগে তার কখনই ক্ষিদে পায়না । কিন্তু আজ যেন ভয়েই পেটটা গুড়-গুড় করছে ।
‘ জগজিৎ ! ডিনারটা সেরে ফেললে হয়না । তারপর নাহয় আবার বসে গল্প শোনা যাবে । ‘
জগজিৎ সম্মতিসূচক একটা ‘জি’ করেই সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলেন ।
ডিনারের আয়োজনটা নেহাত মন্দ করেনি জগজিৎ । বাজরার রুটি আর মটন কষা । মটন এমনিতেই মিঃ গৌরের খুব প্রিয়, মুরগীকে তিনি আবার মাংসের পর্যায়ে ধরেন না । তার মতে মাংস হবে মটন । সঙ্গে তাওয়া রুটি হলে তো জবাব নেই । যদিও বাজারার রুটি তিনি এই প্রথমবারই খাচ্ছেন । খাওয়ার ব্যাপারে তিনি আবার একটুতেই অনেকটা খুশি । তাই খেতে বসেই আবার ‘ আহা-বাহা ‘ শুরু করেছেন ।
‘ গিন্নি রাঁধলো নাকি ? ‘ একটা নুলির হাড় চুষতে চুষতে প্রশ্নটা করেছেন মিঃ গৌর ।
‘ হ্যাঁ , ওই করলো ।ছোট্টুকে বলা ছিল। সে এনে দিল । ‘
‘ আচ্ছা, তুমি যে বললে তুমি এর আগে তিনবার থেকেছো। প্রথম দু’বার ঠিক কি কারণে অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল? সে বারেও কি কেউ অসুস্থ… ‘
‘প্রথমবারেরটা সবচেয়ে সাংঘাতিক ‘ -গৌরের কথা শেষ হবার আগেই কথা বলেছিল জগজিৎ ।
‘ কি রকম? ‘
জগজিৎ মুখের মধ্যে কিছুটা মাংস নিয়ে সেটা চিবতে চিবতে বলল – ‘ সে বার সঙ্গে ছিল প্রফেসর ঝুনঝুনওয়ালা । তিনি ম্যাগাজিনের জন্য একটা আর্টিকেল লিখবেন বলে এসেছিলেন । রাত দুপুরে তার হঠাৎ কি মনে হল, তিনি হাত থেকে খাতা-পেন ফেলে কাঁধ ঝাড়তে লাগলেন । প্রশ্ন করায় তিনি বললেন- কে যেন হাত রাখলেন তার কাঁধে । হাওয়ার মতো কিছু কানের পাশে এসে লাগলো । তারপর আর তিনি এগোলেন না। এমনকি গাড়িতে করে যতক্ষণ তিনি ফিরলেন, সারাক্ষণ আমায় বলে গেলেন – ‘ there must be somethings in the castle… I’m sure.. ‘
‘যাক ভূত তাহলে কেউ দেখেনি বলছো? ‘ জগজিৎ এবার গৌররের কথায় স্মিত হাসল -‘ সবসময় সবটাই কি চোখে দেখা যায় মিঃ গৌর । এই তো জানলা দিয়ে মিষ্টি ফুরফুরে হাওয়া বইছে, তাকে তো দেখতে পাচ্ছেন না, কি করে বিশ্বাস করছেন সে আছে? ‘
মিঃ গৌর আর কিছু বললেন না । তিনি জানেন এ বিষয়ে যুক্তি -তর্ক নিরর্থক । সমস্তটাই ‘ বিশ্বাস ‘ । সেটা থাকলে আছে নইলে নেই ।
‘ আচ্ছা, রাতে কি ঠান্ডা আরো বাড়বে? ‘
-প্রশ্ন হঠাৎ করে বসলেন মিঃ গৌর । কারণ একটা জিনিস তাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভাবাচ্ছে । যখন তিনি নীচে ছিলেন, অর্থাৎ সিড়ি দিয়ে যখন নেমে গেলেন তখন তিনি দেখলেন নীচটা বেশ গরম । অথচ আশ্চর্য বিষয় এই যে, এই ঘরটা যেন অসম্ভব রকমের ঠান্ডা । যেন মনে হয় এই ঘরটা দূর্গের কোন অংশই নয় , তিনি একটা এ. সি রুমে বসে ডিনার সারছেন । এরকম অস্বাভাবিকত্বের কোন কারণ খুঁজে না পেয়েই বোধহয় তিনি প্রশ্নটা জগজিৎ -কে করেছেন । জগজিৎ -ও অবশ্য কোন উত্তর না দিয়ে ঘরের আশপাশটা দেখছে । ঘরটা দেখলে অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে না । মাঝারি ঘর, তার মাঝে চাটাই পেতে তারা ডিনার সারছে । জগজিৎ -এর মাথার পিছনে একটা বড় জানলা । তার বিশাল গহ্বর দিয়ে তাকালে দূরে পাহাড়ের সারি অন্ধকারে দূর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর বলে মনে হয় । জানলা দিয়ে যতটা দেখা যায়, তাতে একফালি আকাশের খানিকটা অংশে কতকগুলো তারার ভীড় । তারামন্ডল । তবে তার নাম জানা নেই মিঃ গৌরের । ডিনার শেষে তারা বাইরে এলেন বোতলের জলে হাত মুখ ধুয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে মিঃ গৌর বললেন -‘ আজ কপালে নেই ! রানী রত্নবতী কিংবা সেই বিশ্রী তান্ত্রিক দুজনেই বোধহয় আজ গভীর নিদ্রায় । ‘
হাত মুখ ধুয়ে তারা ঘরে এসে বসলেন । মোমবাতিটা পুরতে পুরতে এখন প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়েছে । জগজিৎ তার ব্যাগ থেকে আরেক মোমবাতি জ্বালাতে যাবে , ঠিক তখন তারা শব্দটা প্রথম শুনতে পেল । ‘ ঠন ‘ ‘ঠন’ ‘। শব্দ যেন বহু দূর থেকে আসছে । শুধু তাই নয় সেটা যেন তিনদিক ঘেরা পাহাড়ের বিশাল প্রচীরে ধাক্কা খেয়ে প্রতিফলিত হয়ে শব্দের তীব্রতাকে বাড়িয়ে তুলেছে ।
‘ ওটা কিসের শব্দ? ‘ চাপা গলায় প্রশ্নটা করেছে মিঃ গৌর ।
‘ ঠিক বুঝতে পারছি না ! ‘ – চাপা গলায় উত্তর দিল জগজিত । শব্দটা শুনলে মনে হয় পাথরের গায়ে কোন ধাতব বস্তুুর শব্দ । সেই শব্দের একটা ছন্দ আছে । একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে তা যেন হয়ে চলেছে -‘ ঠন’…’ঠন ‘… ‘ঠন’।
মিঃ গৌর এবার বেশ উত্তেজিত । তিনি চাপা গলায় জগজিৎ কে বললেন -‘মোমবাতি নিভিয়ে দাও! ‘ জগজিৎ মিঃ গৌরের কথায় অবাক । ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে , দু’বার কিন্ত কিন্ত করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন । মিঃ গৌর তখনও আঙুলটা বাড়িয়ে রয়েছেন মোমবাতির দিকে । তার চোখ এখন জানলার বাইরে । কান খাড়া । তিনি এখন শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টায় চোখ বুজে রয়েছেন । শব্দটা এখনও এক নাগাড়ে হয়ে চলেছে । শুনলে মনে হয় এই বিশাল প্রেতপুরীতে কেউ তাদের শেষ সংকেত জানিয়ে যাচ্ছে । শব্দের তীব্রতা মাথার মধ্যে চিন্তা ভাবনা সব তাল গোল পাকিয়ে দিচ্ছে । মস্তিষ্ক যখন বিভ্রান্ত তখন মন বলছে – ‘ ফিরে যাও! ফিরে যাও ! ‘
হঠাৎ মিঃ গৌর ফিসফিস করে বলে উঠলেন -‘ গোপীনাথ মন্দির ! ‘ -গেট থেকে বেরিয়ে সোজা ডান দিকে ‘।
জগজিৎ অবাক দৃষ্টিতে তখনও তাকিয়ে মিঃ গৌরের দিকে । জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় তার মুখের চেহারা দেখলে বোঝা যায় সে কতটা সন্ত্রস্ত ।
‘আপনি কি করে … ‘
‘ ম্যাপটা মনে করার চেষ্টা করছিলাম । শোনো কেল্লার পিছনে যাবার কোন পথ আছে ? ‘
‘ হ্যাঁ, সিড়ি দিয়ে নেমে বাঁদিকে একটা ভাঙা পাঁচিল আছে সেটা দিয়ে ‘ – থতমত খেয়ে উত্তর দিল জগজিত । সে এখনও বুঝে উঠতে পারেছে না মিঃ গৌর কি করতে চলেছে ।
এর মধ্যেই মিঃ গৌর তার হাতের পাঁচ সেলের টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন । পিছু পিছু জগজিতও এসে পড়েছে । মিঃ গৌরের মধ্যে হঠাত এভাবে উত্তেজনার সঞ্চার হতে দেখে সেও মনের ভয়টা এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলেছে । তারা এখনও জানে না সামনে তাদের জন্য কি বিভীষিকা অন্ধকারে মরনফাঁদ ফেঁদে রেখেছে । কিন্তু তারা এটা জানে এখন যদি তারা পিছিয়ে আসে তাহলে ভানগড় দূর্গের রহস্য রহস্যই থেকে যাবে ।
ওরা কাঁটা ঝোপ পেরিয়ে খাঁড়া পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে অন্ধকারে দ্রুতপদে একটা মরা গাছের পিছনে এসে দাঁড়াল । অন্ধকার মন্দিরের ফাঁকা দরজা হাঁ করে রয়েছে । হয়ত এর মধ্যেও কয়েক হাজার চামচিকি নিঃশব্দে লুকিয়ে রয়েছে । সেদিকে আলো ফেললেই তারা তেড়ে আসবে তাদের জলন্ত সবুজ চোখ নিয়ে ।
শব্দটা এখন থেমেছে । হয়ত বিরতি । কিন্তু মুহুর্তেই আবার আগের ছন্দে বেজে চলল সেই ধাতব ধ্বনি – ঠন…ঠন…ঠন ।
‘ মন্দিরের ঘন্টা … ? ‘ – প্রশ্নটা যেন মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে এল জগজিতের । তার স্নায়ু এখন টানাটান । জামা ঘামে ভিজে গেছে । কাঁটা-ঝোপে পা কেটে রক্ত পড়ছে ।
‘ না ! পাথর কাটছে … । ‘ – গম্ভীর কন্ঠে উত্তর এল । মিঃ গৌর তার পাঁচ সেলের টর্চটা শক্ত করে ডান হাতে চেপে ধরছেন । তারপর তিনি
একপা-দুপা করে অন্ধকারে মিশে এগোতে লাগলেন । হঠাত মন্দিরের ভেতর একটা আলোর ঝলক । তারা মুহুর্তে নীচু পাথরের পিছনে বসে পড়লেন । মাথাটা খানিকটা তুলে মিঃ গৌর দেখলেন দুটো কালো অবয়ব ঘোরাফেরা করছে মন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালে । আর ঠিক সেখান থেকেই আসছে শব্দটা । জগজিত হয়ত অন্যমনষ্কের বসেই পিছনের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষনের জন্য । পরক্ষনেই যখন সামনে তাকালো সে দেখল , মিঃ গৌর আর সামনে নেই । এই অন্ধকারে তিনি কোথায় গেলেন সেটা ভাবার আগেই একটা চাপা গোঙানির শব্দ মন্দি্রের ভেতর থেকে । তারপরই একটা ধপ করে পড়ে যাবার শব্দ । কি থেকে কি হল সেটা বুঝে ওঠার আগেই সে দেখল তার প্রায় মাথার ওপর দিয়ে একটা লম্বা পা তাকে ডিঙিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল । মূহুর্তে যেন সে বিপদের আঁচটা বুঝেতে পেরেই পাথর ডিঙিয়ে অন্ধকারেই দৌড়ে ঢুকল মন্দিরের ভেতরে । তার ঢুকতেই কি যেন একটা তার পায়ে লেগে গড়িয়ে গেল । একটু এগিয়ে হাতড়াতেই সে বুঝলো সেটা মিঃ গৌরের টর্চ । সেটা জ্বালতেই দেখা গেল দুজন মাটিতে পড়ে রয়েছে । একজন সম্পূর্ন অচেতন । অন্যজন তখনও যন্ত্রনায় কাতারাচ্ছে । মিঃ গৌর ! … । অস্ফুট গলায় তিনি বিড়বিড় করে বলছেন – ‘ একজন পালাচ্ছে … ওকে ধরো , ওকে ধরো ।
মাথায় পাঁচ সেলের টর্চের বাড়ি খেয়ে একজন আগেই জব্দ হয়েছিল । পরদিন সকালে তাকে জেরা করেই পুলিশ আরেকজনের সন্ধান পেয়ে তাকেও হাজতে পুড়তে পেরেছিল । মিঃ গৌরের মাথার ব্যাথা অবশ্য বেশ কিছুদিন ছিল । তবে তার লেখা প্রতিবেদন – ” দ্য আল্টিমেট ট্রুথ অফ ভানগড় ফোর্ট ” , ট্রিবিউন ক্রনিক্যাল পত্রিকার সবাক্রাইবার যে বেশ কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল তাতে ক